মানুষের ঘরবাড়ি
মাস দুয়েক আগেই একটা বেশ লম্বা ভ্রমণ শেষ করেছি। পুজোতেও টুকটাক ঘোরাঘুরি যা হয়েছে তাও মন্দ নয়। তারপরে কালীপুজো ভাইফোঁটার ছুটিতে আবার বেড়াতে যাওয়া? যদিও অনেকদিন ধরেই আমার চব্বিশ ঘণ্টাই ছুটি, সুতরাং সেটা নির্ণায়ক বিষয় নয়। কন্যার ছুটি, এক্ষেত্রে সেটাই একমাত্র বিচার্য। "রক্ষে করো বাবা" বলে প্রথমেই হাত তুলেই দিয়েছিলাম, কিন্তু এদিক ওদিক থেকে কারোর বেড়াতে যাওয়ার খবর পেলেই মনটাও নড়েচড়ে ওঠে, সে তখন ভাবতে বসে আমরা কি তাহলে ছুটির দিনগুলো বাড়িতেই বসে বসে কাটাব? এই সমস্ত ভাবনচিন্তার মাঝেই কিছুটা কাকতালীয় ভাবেই খোঁজ পেলাম 'মানুষের ঘরবাড়ি'-র, ফেসবুকের পাতায় তার সপ্রশংস উল্লেখ জায়গাটা সম্পর্কে মনটাকে কিছুটা আগ্রহান্বিত এবং কৌতূহলী করে তুলল। এটা আসলে একটা খামারবাড়ি, অতীন বন্দোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাসের নামে নামাঙ্কিত, যেখানে একটা হোমস্টের ব্যবস্থা আছে। যে দুটো কারণে সেখানে গিয়ে দিন দুয়েক কাটিয়ে আসার কথা মনে হলো, তার একটা হলো ফেসবুকের ওই লেখাটা। মনে হয়েছিল লেখক কোনো সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারের ভূমিকা পালন করার জন্যে সেটা লেখেননি, অতএব এই ক্ষেত্রে লেখকের মূল্যায়নের ওপর আস্থা রাখা গেলেও যেতে পারে। আর দ্বিতীয় কারণ ছিল লাভপুরের কাছাকাছি অবস্থিত এই হোমস্টের দূরত্ব বোলপুর থেকে প্রান্তিক, কঙ্কালিতলা ছাড়িয়ে প্রায় পঁচিশ কিমি, তাই ভেবেছিলাম শান্তিনিকেতনে সপ্তাহান্তিক ছুটি কাটানোর যে বাঁধা গত আছে এটা তার থেকে কিছুটা হয়তো অন্যরকম হতে পারে, কাজেই একবার গিয়েই দেখা যাক। বাড়িতে বলেই দিলাম সোনাঝুরির ওই হট্টমেলার ত্রিসীমানার মধ্যে আমি যাব না, তার ফলে যদি হোমস্টের ঘরের মধ্যে দুদিন আটকে থাকতে হয়, সেও ভি আচ্ছা। ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে মানুষের ঘরবাড়িতে থাকার জন্যে একটা ঘরের ব্যবস্থা হলো। আমাদের সেখানে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে রাকার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী লালি জানালেন, ‘মানুষের ঘরবাড়ি’-র পরিকল্পনা এবং রূপায়ণের পেছনে যে দুজন মানুষ রয়েছেন, তার মধ্যে অধ্যাপিকা সাহানার সঙ্গে কর্মসূত্রে লালির বেশ ভালোই পরিচয় আছে, আর অন্যজন হলেন সুপরিচিত চলচ্চিত্র-নির্মাতা ও সাংবাদিক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়।
এর পরের কথাগুলোকে নিয়ে আর বেশি এগোনোর আগে এখানে একটা বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের প্রয়োজন আছে। এটা কোনও ভ্রমণের বিবরণ নয়, কারণ আমরা কোথাও বেড়াতে যাইনি। অনেক ছুটির দিন যেমন আমাদের নিজেদের বাড়িতে বসে বসে শুধু খেয়ে-দেয়ে আর ঘুমিয়েই কেটে যায় কতকটা সেই ভাবেই আমাদের এই দুটো দিন কেটেছিল, তবে নিজেদের বাড়িতে নয়, শহর থেকে দূরে বেশ অন্য রকম একটা পরিবেশে, অন্য কারোর বাড়িতে। এখানে ‘সাইড সিন’ করার কোনও সুযোগও ছিল না অথবা, ক’টা স্পট দেখলাম নম্বর ধরে ধরে সেটার তালিকায় টিক মারারও কোনো গল্প ছিল না। কাজেই এই ছুটি কাটানো সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে যেখানে ছিলাম সেই ‘মানুষের ঘরবাড়ি’-র কথাটুকুই শুধু বলতে হয়। আগেই বলেছি, ‘মানুষের ঘরবাড়ি’-র অবস্থান বীরভূম জেলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। গাড়ি থেকে নেমে চারপাশে তাকিয়ে চোখে পড়ল শুধুই বিস্তীর্ণ ধানি জমি, বয়স্ক ধানগাছের সবুজ পাতার রঙের সাথে মিশে গিয়েছে হেমন্তের পাকা ফসলের সোনালি রঙ। কাছাকাছি যে গ্রামটা থেকে মেলার গানের আওয়াজ বাতাসে ভেসে আমাদের কানে এসে পৌঁছাচ্ছিল, বিকেলে সেই মেলায় যেতে টোটো চড়েও আমাদের সময় লেগেছিল প্রায় মিনিট দশেক। যেটুকু বুঝলাম, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের কোনও উপকরণের প্রয়োজন হলে সম্ভবত যেতে হয় পাঁচ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে সেই লাভপুর অথবা কীর্ণাহার, অথবা আরো দূরে বোলপুর। ‘মানুষের ঘরবাড়ি’-র মূল ফটক খুলে ভিতরে প্রবেশ করলে ছবিটা আবার অন্যরকম। একটা বেশ বড়োসড় পুকুর, তার চারপাশে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছড়ানো আছে ফলের বাগান, ফুলের গাছ, গোয়াল-ঘরে চারটে গরু, হাঁস-মুরগিদের একসাথেই থাকার একটা জায়গা আর খরগোশদের জন্যে আছে একটা ‘বারো’। এরা ছাড়াও এখানে থাকে এক জার্মান শেফার্ড, যার নাম ‘আঁটি’। এখানে আম-জাম-কাঁঠাল-লিচু-জামরুল ইত্যাদি অজস্র ফলের গাছে পাখিদের ওড়াউড়ি আছে, পুকুরের জলে মাছেদের ঘাই মারা আছে, জলের ধারে ওঁত পেতে বসে থাকা বক-সারস-মাছরাঙারা আছে, সর্ষের খেত আছে, সবজির বাগান আছে। কতো রকমের যে লেবুগাছ দেখলাম তার ইয়ত্তা নেই, তার মধ্যে কিছু গন্ধরাজ লেবু তো এতটাই বড়ো যে দূর থেকে দেখে সেগুলোকে পাকা বেল বলেও ভ্রম হতে পারে। আর সেই পরিবেশের মধ্যেই রাখা আছে আমাদের মতো বাইরে থেকে ঘুরতে যাওয়া মানুষদের জন্যে সাজিয়ে রাখা চারটে ঘর, তার মধ্যে একটা আবার মাটির দোতলা বাড়ি।
সেই মাটির দোতলা বাড়িতে একতলার ঘরটায় দিব্যি আমাদের কেটে গেল দুটো রাত। ঘরের অভ্যন্তরটা বেশ ছিমছাম, তবে বাহুল্যবর্জিত। দিনের মধ্যে যখনই সেই মাটির ঘরের বারান্দায় গিয়ে বসেছি, অনেকটা সময় ধরে শুধু ছাতারেদের কলরব আর বেনে-বউয়ের ডাকাডাকি ছাড়া কিছুই আর কানে যায়নি। সামনের রাস্তা দিয়ে সামান্যই লোক চলাচল করে, যানবাহন চলাচলও বেশ কম। এই নৈঃশব্দ, এই নির্জনতা, এই সবুজের সমারোহ আর এই গ্রামীণ আবহই এখানকার আকর্ষণ, আর তার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছে পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখা এখানকার খাওয়া-দাওয়া। পুকুরের মাছ, খেতের ধানের চাল-ডাল-সর্ষে, বাগানের সবজি, গোয়ালের গরুর দুধ থেকে তৈরি ঘি, খামারের হাঁস-মুরগির ডিম এই সব উপকরণ দিয়ে তৈরি সুস্বাদু সব রান্না পরিবেশন করে খাওয়াতেন রান্নাঘরের দিদিমনি, গৃহকর্তা এবং গৃহকর্ত্রীর তত্ত্বাবধানে খেতে বসে সেখানে কম করে খাওয়ার কোনও উপায় ছিল না। সাহানা এবং অনিকেতবাবুর আন্তরিকতা এবং উষ্ণ আতিথেয়তায় তুলনা হয় না, আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর রাখা ছাড়াও খাবার টেবিলে আমাদের সঙ্গে কথোপকথনে অনেকটাই সময় দিতেন এই দুইজন মানুষ। তাঁদের আকর্ষণীয় আলাপচারিতায় উঠে আসতো মানুষের ঘরবাড়ি গড়ে ওঠার কাহিনী, দেশে-বিদেশে তাঁদের বেড়ানোর কথা, সমাজ-সিনেমা-রাজনীতি ইত্যাদি আরও নানা বিষয় নিয়ে মনোগ্রাহী টুকরো টুকরো সব গল্প - যে আলোচনায় সমৃদ্ধ হতাম আমরা। আমাদের ঘরে টিভি যে ছিল না সেটা একটা বাঁচোয়া, তবে বিনোদনের অন্য কিছু উপকরণ যেমন পুকুরের জলে বোটিং, মাছধরা, চাঁদমারি ইত্যাদি মজুদ আছে ‘মানুষের ঘরবাড়ি’-তে, যদিও আমাদের সেগুলোর প্রয়োজন হয়নি। এর মধ্যেই এক বেলা ঘণ্টা তিনেক টোটো চড়ে ঘুরে এলাম লাভপুরে সাহিত্যিক তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়ের স্মৃতি-বিজড়িত বাড়ি ধাত্রীদেবতা আর কোপাই নদী যেখানে হাঁসুলির মতো বাঁক নিয়েছে, ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ খ্যাত সেই হাঁসুলি বাঁক। একটু ধম্মো-কম্মোও করে নেওয়া হল একান্ন সতীপিঠের অন্যতম দেবী ফুল্লরার মন্দির দর্শন করে।
ফেরার দিন ‘মানুষের ঘরবাড়ি’-র তরফ থেকে উপহার পাওয়া গেল সেখানকার গাছের ইয়াব্বড়ো এক গন্ধরাজ লেবু আর খেতের গোবিন্দভোগ চাল। মানুষের ঘরবাড়িকে বিদায় জানিয়ে, একটা সুন্দর অভিজ্ঞতার জন্যে সাহানা এবং অনিকেতবাবুকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। সোনাঝুরির ত্রিসীমানায় না যাওয়ার ওই প্রতিজ্ঞাটা শেষ অবধি আর বজায় রাখা যায়নি। আর চারবেলা নানাবিধ সুখাদ্য ভরপেট ভক্ষণ করার পরে ফেরার সময় শতাব্দী এক্সপ্রেসের খাওয়াটা ছিল অনেকটা ফাইনালে ভারতীয় দলের ব্যাটিংয়ের মতোই একেবারে চরম একটা অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স!
Kanad Chowdhury