কথায় বলে চক্ষু কর্ণ নাসিকার বিবাদভঞ্জন। কেন? জিহ্বা কি দোষ করলো? তারও তো বিবাদ ভঞ্জনের একটা বাসনা থাকতেই পারে। আর সে যদি হয় আমার মতন বিশুদ্ধ বাঙালের রসনার সহচর।
আমি দেশে বিদেশে যেখানেই যাই, কাজে কিম্বা ভ্রমণে, সব জায়গাতেই দেখার সঙ্গে, শোনার সঙ্গে, খাবারদাবার চেখে দেখার জন্যেও ঘুরি। বিদেশে আমি স্থানীয় খাবার খেয়ে নিয়ে খানিকটা আন্দাজমতন সেইসব পদ নিজে রেঁধে খাই, খাওয়াই। তাতেই আমার আনন্দ চতুর্গুণ বেড়ে যায়।
এইবারের দুর্গাপুজোয় পরিবারের সবাই মিলে ঠিক করেছিলাম যে তাড়াতাড়িই কাছেপিঠে কোথাও গিয়ে একটু জমিয়ে বসে আড্ডা মারবো, খাবো দাবো আর গড়িয়ে জিরিয়ে নেবো। সেইমতো ছোটভাইকে বলাতে ও আমাদের সবাইকে নিয়ে বেড়ানোর জায়গা খুঁজে সাব্যস্ত করলো ‘মানুষের ঘরবাড়ী’। সবাই যেই শুনেছে শান্তিনিকেতনের কাছে, আবার সেখানে? বলে ভেটো দেবার জন্যে নড়েচড়ে বসলো। কিন্তু, ভাইয়ের কাছ থেকে মানুষের ঘরবাড়ীর বর্ণনা আর খাবারের ফিরিস্তি শুনে সকলে রাজি হয়ে গেলো।
অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটতে গিয়ে দেখি আমাদের সুবিধে মতন গণদেবতা এক্সপ্রেসে কোন টিকিট নেই। সেই ট্রেনে হলে নামতে পারতাম বেড়ানোর জায়গার খুব কাছে, প্রান্তিক স্টেশানে। তাই খুব সকালের বন্দে ভারতে টিকিট কাটলাম। মনে মনে বললাম ভালোই হলো, এই সুযোগে এই ট্রেনে প্রথম চড়ার আনন্দটাও উপভোগ করা যাবে। তবে, নামতে হবে বোলপুরে। ট্রেনের টিকিট কেটে জানিয়ে দিলাম গাড়ী যেন বোলপুরে পাঠানো হয়।
সবারই ইচ্ছে ছিলো পূর্ণিমায় সেখানে থাকার। তাইই হলো। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর পরেরদিন কাকভোরে হাওড়া স্টেশানে গিয়ে চড়ে বসলাম বন্দে ভারতে। কাঁটায় কাঁটায় সকাল পাঁচটা পঞ্চান্ন মিনিটে সাত নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে দিলো ট্রেন।
প্রাতরাশ এলো, তার আগে চা বিস্কুট আর এক বোতল রেলনীর। জলখাবার শেষ হতেই বিজ্ঞপ্তি এলো প্রথম স্টেশান বোলপুর শান্তিনিকেতনের। পাঁচ মিনিট পরেই থেমে গেলো ট্রেন। স্টেশানে নেমে বাইরে আসতেই দেখি দুটি গাড়ী নিয়ে চালকেরা অপেক্ষারত। আমাদের দেখে চালকদের দলপতি রামকৃষ্ণ এগিয়ে এসে কথা বললো। মালপত্র তুলে নিয়ে লাভপুরের দিকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো।
প্রায় মিনিট পঁচিশ পরে এসে মানুষের ঘরবাড়ীর গেটের কাছে নামলাম। বলে দেওয়াতে যার যার মালপত্র তাদের তাদের ঘরগুলিতে পৌঁছে গেলো। আমরা এসে বসলাম রান্নাঘরের সামনে বাঁধানো শানের খাবার জায়গায়।
শুরু হলো আমাদের অবাক হবার পালা। ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক এলো। কাচের গ্লাস তুলে মুখে ঠেকাতেই প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। গুড়জলে গন্ধরাজ লেবুর ঘ্রাণ ম ম করছে। সে এক অতি আরামের পানীয়।
নিজেরাই বসে সেখানে আড্ডা শুরু করেছি। এই ফাঁকে সকালের জলখাবার চলে এলো। ফুলকো লুচি, গরম গরম লম্বা বেগুন ভাজা, সাদা আলুর চচ্চড়ি আর দুধসাদা কর্পূরসুরভিত নারকোলের নাড়ু।
বন্দে ভারতের নন-ভেজ প্রাতরাশ ভুলে গেলো সবাই। পেটে জায়গাও হয়ে গেলো রাজকীয় জলখাবারের জন্যে। খুব উপভোগ করে খেলাম সকলে।
খাবার জায়গায় একদিকে একটা স্ক্রীন গোটানো রয়েছে। সময় সময়ে প্রোজেক্টার বসিয়ে সিনেমা দেখানো হয় আব্দার অনুযায়ী। মাঝে মধ্যে আশেপাশের গ্রামের বাচ্চাদের নিয়ে গুপি গাইন বাঘা বাইন কিম্বা হীরক রাজার দেশে ছবিগুলি দেখা হয়।
এইবারে নিজের নিজের ঘরে এলাম জামা কাপড় বের করে গুছিয়ে নিতে। এসেই আবার অবাক হবার পালা। প্রতি ঘরে বিছানার ওপরে একটা করে মানুষের ঘরবাড়ী ছাপানো গাত্রমার্জনী, যাকে চলতি কথায় গামছা বলে ডাকি। সঙ্গে সাবান শ্যাম্পু। ঘরের একদিকে চায়ের সরঞ্জাম, ইলেক্ট্রিক কেটল, টী ব্যাগ, কাপ চামচ ইত্যাদি। ঘরে কোন টিভি সেট নেই। কোন ঘরেই টিভি রাখা হয়নি।
আমাদের জন্যে চত্বরের সবকটি ঘরই বুক করেছিলাম। বড়োদাদা বৌদির জন্যে গেট দিয়ে ঢুকেই একটা এসি রুম। আমি আর মেজোদাদা মাটির দোতলা বাড়ীর একতলা, যার নাম লালবাড়ী আর ছোটভাই দোতলার নীলবাড়ী নিয়েছিলাম। আর, কন্যাদের জন্যে ছিলো সব শেষের হাইফাই একখানা বড়ো ঘর, এসির। এই বাড়ীটা দোতলা, যার ওপরের তলায় মালিক মালকিন অনিকেত আর সাহানা থাকেন।
আমাদের মাটির বাড়ীর একতলা ঘিরে চওড়া বারান্দা। তাকে ঘিরে বসার জন্যে শানের বেঞ্চ বানান। চেয়ার টেবিলও আছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্লাগ পয়েন্ট রয়েছে সুবিধে অনুযায়ী ব্যবহারের জন্যে। সেই বারান্দার একদিকে একটা ঢেঁকি রয়েছে। ঘেরা জালের সীমানা পেরিয়ে গোয়ালঘর। দুটি দুধেল গাভী আছে।
একদম গেটের কাছে একটা রক্তিম গুলঞ্চের গাছ, অপূর্ব ফুল ফুটেছে তাতে। সামনের এসি ঘরের বিপরীতে একখানা ঘর রয়েছে গ্রিলের দরজা দেওয়া। তার ভেতর থেকে এক জিএসডি উঁকি মারছে। নাম তার আঁটি। বয়েস হয়েছে, একটু স্থুল। তার সহচর ভেঁপু কয়েক মাস আগে মারা গেছে।
মানুষের ঘরবাড়ী বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে। কি অপরূপ সবুজের সমারোহ। চত্বরের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় খান দশেক শিউলি ফুলের গাছ। ভরভরন্ত ফুলের সুবাসে চারিদিক আমোদিত। পায়ে চলে গল্প করতে করতে ঘুরে নিলাম চারিদিক। সব্জির বাগান, ফলের বাগান, বিঘা খানেক বিস্তৃত পুষ্করিণী। মাছেরা ঘাই মারছে। জায়গায় জায়গায় মুরগী, হাঁস, খরগোশের খাঁচা, অনেক জায়গা জুড়ে। হাঁসেদের পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হলো আমাদের সামনেই।
সবুজের সমারোহের যেন শেষ নেই। অসীম। কতো রকমের আমের গাছ। ল্যাংড়া ফজলী তো আছেই আর আছে হিমসাগর। সব গাছেই মরশুমে ফল ধরে, কয়েকটা আবার বারোমাসি। আমের পাশাপাশি জাম রয়েছে, রয়েছে কাঠালের গাছ। পেয়ারার গাছ তো একটু দূরে দূরেই। কলা গাছও বেশ কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে, পুকুরের ধার ঘেঁষে অনেক। তাল গাছ, বেল গাছ, কয়েৎবেল বা কদবেল গাছ আর কতো রকমের ফলের গাছ তা মনে করে বলে শেষ করা যাবেনা। একটা চালতা গাছে কি সুন্দর একজোড়া নধর চালতা ফলেছে। কুল গাছও আছে খানকতক, তার একটি নারকেলি কুলের। এতো কুল হয় যে খেয়ে ছড়িয়ে সারা বছরের চাটনী করার জন্যে শুকিয়েও রাখা হয়।
ফলের গাছের বাগিচা যেমন নজরকাড়া, ফুলের কিন্তু অতো নয়। শিউলি আর স্থলপদ্ম ছাড়া সেরকম ফুলের গাছ দেখলাম না। তবে দেখলাম নিজস্ব নার্সারিতে প্রচুর মরশুমি ফুলের চারা করা হয়েছে, কিছু বিক্রি করা হয় আবার কিছু চত্বরের সামনের দিকে কেয়ারী করে লাগানো হয়। চন্দ্রমল্লিকা আর বিভিন্ন গাঁদা ফুলের চারা দেখলাম আগামী শীতে বাগান আলো করার জন্যে তৈরী হচ্ছে।
সব্জির বাগানও দেখার মতো। উচ্ছে, করলা, ঝিঙে, কুমড়ো, চাল কুমড়ো, লাউ, সর্ষে ক্ষেত, অড়হর কলাইয়ের ক্ষেত, বিউলির ক্ষেত, আঁখের ক্ষেত, পেঁয়াজের জমি, লাল নটে, কলমির ঝাড় কতো কি! গ্রীন হাউস করে ফুলকপি, বাধাঁকপি ওল কপির চারা তৈরী করা হয়েছে। ক্যাপ্সিকাম বা শিমলা মরিচের গাছও করা হয়। আর, লংকার গাছ তো অনেক হয়ে রয়েছে। একটা ঝিঙে দেখলাম যা আগে দেখিনি কখনো। গোল ঝিঙে। গড়ন একদম আপেলের মতন, খেতেও নাকি খুব স্বাদ। গাছে অনেকগুলো শুকিয়ে রয়েছে। পরের বছরের বীজের উৎস।
পুকুরের অন্যধারে কয়েকটা খেজুর গাছ। শীতে গাছ কাটিয়ে রস বের করা হয়। নলেন পয়রা গুড় পাওয়া যায় তখন। আর, সোমবচ্ছরের আখিগুড় হয় আখের, যা চাটনীতে, মিষ্টিতে পড়ে।
বারোমাসের সর্ষের তেল আসে নিজেদের ক্ষেতের সর্ষে থেকে। ভাঙ্গানো হয় পাশের গ্রামের কলুর দেশী ঘানীতে।
লেবু নিয়ে তো একটা পুরো অধ্যায় লিখে ফেলা যায়। প্রতিটি ঘরের অঙ্গনে রয়েছে গন্ধরাজ লেবুর গাছ। ফলভারে নুয়ে মাটি স্পর্শ করেছে তারা। পিছনের দিকে রয়েছে পাতিলেবুর বেশ কিছু গাছ, সবেতে ফল ধরেছে। পূর্ব দক্ষিণের সারাটা গন্ডীর বেড়াই এক ধরণের কাগজী জাতীয় বড়ো বড়ো লেবুর গাছ দিয়ে করা। সেগুলোতে বীজ হয়না, ঠিক যেমন বিদেশী রান্নায় কেটে কেটে দেওয়া বড়ো বড়ো লেবুতে দেখিনা।
খুব বেশী ধরণের না হলেও ধান হয় মানুষের ঘরবাড়ীতে। ভেজালবিহীন গোবিন্দভোগের কি অপূর্ব সুঘ্রাণ। আর হয় রোজকারের খাবারভাতের জন্যে লাল স্বর্ণ ধান কিম্বা আই আর ৩৬।
খাবারের কথা বলতে গিয়ে পাশ কাটিয়ে চলেছি তো চলেইছি। নাঃ, অতঃপর সেকথায় তো আসতেই হয়। সে কি যে সে ভাবে বলার? নাকি, বললেও সুখ হবে!
প্রথম দিন সকালের জলখাবার নিয়ে আর বেশী বললাম না। তবে আন্দাজ একটা পাওয়া গেলো পরে পরে কি ধরণের খাবার অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে।
দুপুরবেলা যারা স্নান করে আসেনি যেমন আমি, স্নান সেরে এসে আবার বসলাম সেই খাবারের শানের টেবিলে, রান্নাঘরের সামনে। এই দুপুরেও শিউলির গন্ধে পুরো চত্বর সুগন্ধিত।
একে একে টেবিলে সকলের জন্যে এলো ঝকঝকে খাগড়াই কাঁসার থালায় করে ভাত, শুক্তো, আলু ভাজা, মাছ ভাজা, ভাজা মুগের ডাল, বাঁধাকপির ঘন্ট আর নিজেদের পুকুরের তাজা মাছের ঝাল, সর্ষেবাটা দিয়ে। তার সঙ্গে জলপাইয়ের চাটনী এবং দই আর রসগোল্লা। কবজি ডুবিয়ে খেয়ে নিলাম। ভাতের পরিমাণ দেখে ভেবেছিলাম যে খুব বেশী হয়ে যাবে। কেউ কেউ ভাত কমিয়ে নিলো। খাওয়া শুরু হলো খাঁটি গব্য ঘ্রীতের এর সঙ্গে। আমি তো পুরোটাই খেয়ে ফেললাম। এরপরে ভাতঘুম তো অবশ্যম্ভাবী। লালবাড়ীর মাটির ঘরের শীতল আমেজে বেশ জমিয়ে ঘুম হয়েছে।
বিকেলে ঘুম ভাঙ্গলো ভাইয়ের ডাকে। চায়ের আসর বসেছে গোল টেবিলে। গিয়ে দেখি থালায় করে মুড়ি, পেঁয়াজী আর গরুর দুধের হালকা মিষ্টি দেওয়া চা রাখা। খেয়ে নিলাম কাঁচা লংকা আর পেঁয়াজের সঙ্গে। এক কথায় দারুণ।
বিকেলে সবাই মেয়েদের হাইফাই ঘরে জমিয়ে বসলাম। সকলে বোর্ড গেম পেতে অনেকক্ষণ খেলে নিলাম। রাতের খাবারের ডাক আসাতে আবার সবাই চলে এলাম রান্নাঘরের কাছের টেবিলটাতে।
আমাদের আবদার অনুযায়ী ভাতের সঙ্গে ছিলো হাঁসের ডিমের কষা, অড়হর কলাইয়ের ডাল, ফুলকপির ডালনা, বেগুন ভাজা, পটল ভাজা আর টোপা কুলের চাটনী। আর ছিলো ল্যাংচা। আমার মেয়ের ডিমে এলার্জি, তাই ওর জন্যে এলো মাছ ভাজা।
পরের দিন শুরু হলো পাখির কলকাকলিতে। খুব ভোরে ওঠা আমার অভ্যেস। শান বাঁধানো লাল মাটির ঘরের পাটায় বসলাম। তার আগেই ঘরে রাখা সরঞ্জামের সদব্যবহার করে চা বানিয়ে এনেছি। সেই চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভোরের সূর্যের ঘুম ভাঙ্গার ছবি তুলে নিলাম মোবাইলে। লালঘরের টালীর চালের দিকে নজর গেলো। দেখি সারি সারি ঝুঁটি বাঁধা পেঁয়াজ ঝুলছে পুরো ছাদ জুড়ে। সারা বছরের রসদের মজুদ।
আমি আর মেয়েরা রয়ে গেলাম নিজেদের মতন। বড়োদাদা, বড়ো বৌ, মেজোদাদা আর ছোটভাই সকাল সকাল স্নান সেরে একটা টোটো ধরে চলে গেলো কিছু দূরের শক্তিপীঠ ফুল্লরা মায়ের দর্শনে। শুনলাম আরো কাছে নানুরে রয়েছে টেরাকোটার মন্দির বেশ কয়েকটি। সময়ের অভাবে সেখানে এই যাত্রায় যাইনি। পরে কখনো দেখে নেবো।
কিছু শিউলি ফুল কুড়িয়ে কালো শানের ওপরে নকশা এঁকে নিলাম। ততক্ষণে গাই দোয়াবার কাজ শুরু হয়ে গেলো। শুনলাম দুপুরের খাওয়ার সঙ্গে থাকবে গোবিন্দভোগের পায়েস।
সকালের জলখাবারে এলো তেকোনা পরোটা, সঙ্গে ছোট আলুর দম, পটল ভাজা আর নারকোলের নাড়ু। শেষে এক কাপ করে দুধেল চা। মালতী দিদি আর তার সহচরী বালিকা দিদি পরিপাটি করে সব রাঁধে, গুছিয়ে খেতে দেয়। তাদের আশেপাশেই দেখতে পাওয়া যায় মদনবাবুকে। সে কিছু এনে দেয়। এটা সেটা করে জুগিয়ে দেয় সব কিছু হাতের সামনে। ক্ষেত থেকে দেখি এক ঝাড় আদা তুলে এনে রাখলো রান্নাঘরের দাওয়ায়।
প্রাতরাশ সেরে চললাম পুকুরধারে। শান বাঁধানো ঘাটে আমার জন্যে চেয়ার পেতে রাখা ছিলো। মদনবাবু চার ছড়িয়ে রান্নাঘর থেকে টোপের জন্যে এল দলা ময়দা মাখা এনে দিলো। কেয়ার টেকার বাবন মণ্ডল দুটো বরশি লাগানো সরু বাঁশের ছিপ দিয়ে গেলো।
আমার দেখাদেখি আমার মেয়েও একটা ছিপ নিয়ে বসে পড়লো। টোপ লাগিয়ে ফাৎনায় নজর রেখে বসে রইলাম। প্রচুর মাছ পুকুরে, ছোট বড়ো রুই কাতলা মৃগেল, ঘাই মারছে এধারে ওধারে। বহুবার ফাতনায় হিল্লোল দেখে টান মেরেছি, কিন্তু আমাকে হতাশ করে মাছেরা পালিয়েছে, খেয়ে গেছে টোপ। ঘণ্টা দুয়েক বসে নিরাশ হয়ে উঠে পড়লাম। এক কাপ চা খেয়ে ঘরে গেলাম স্নান করে নিতে। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দারুণ গন্ধ পেলাম মাংসের ঝোলের।
খেতে বসে দেখি থরেবিথরে কাঁসার বাটিরা থালার চারিপাশে বিরাজমান। ভাত, করলা ভাজা, বিউলির ডাল, আলু ঝিঙ্গে পোস্ত, থনথনে কলমি শাক ভাজা, চালতার চাটনী আর গোবিন্দভগের পরমান্ন পরিবেশিত হয়েছে। সব থেকে বড়ো বাটিটাতে ব্ল্যাক বেঙ্গল পাঁঠার মাংস এলো। ছোটভাই আগে থাকতে সেই মাংসের আর্জি জানিয়ে রেখেছিলো। খেতে খেতে জিহ্বা মুগ্ধ। কেউ কথা বলছেনা; কেবল খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে রান্নার তারিফ করা ছাড়া।
খেয়ে নিয়ে সবাই এসে বসলাম মাটির ঘরের দাওয়ায়। আড্ডা চললো বিকেল পর্যন্ত। তখনই জানতে পারলাম যে সন্ধ্যেবেলা বারবিকিউ করা হবে। মেয়েদের হাইফাই ঘরের পাশেই একটা বড়ো জায়গায় বারবিকিউ কিম্বা চড়ুইভাতির রান্নার সেট আপ। সেখানে সন্ধ্যের পরে সরঞ্জাম জড়ো হতে লাগলো। ম্যারিনেট করা খাদ্যের সম্ভার এলো গামলায় ঢাকা দিয়ে। বিজলিবাতির তেজে চারিদিক উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। পাশের শিউলি গাছে তখন কুঁড়িরা ফুটতে শুরু করেছে সুগন্ধে মথিত করে। কৃষ্ণচূড়া গাছের ফাঁক দিয়ে তৃতীয়ার চাঁদের মুখখানি দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।
একেই সবকিছুর আয়োজন দেখে সবাই মুগ্ধ, তাইতে হঠাৎ সকলকে অবাক করে দিয়ে অনিকেত আর সাহানা উপস্থিত। তাঁরা বেড়াতে গিয়েছিলেন নেপালে, আমাদের জানানো হয়েছিলো তাঁরা ফিরবেন যেদিন আমরা চলে যাবো, তাই দেখা হবেনা। কিন্তু বিস্মিত হয়ে গেলাম ওদের দেখে। পরে জানলাম এটা ওদের প্ল্যানেই ছিলো; আমাদের সারপ্রাইজ দেওয়া। তারপরে আর কি! বিস্ময়ের পর বিস্ময়।
মুরগীর মাংস আর ম্যারিনেটেড আলু গ্রীল করা শুরু হলো। মদন বাবু এসে কাঠের আগুন জ্বলে দিলো। সেই আগুন যখন ধিকি ধিকি তখন বারবিকিউ র্যাকের ওপরে মাংস আলু সব বসিয়ে দেওয়া হলো। সঙ্গে চললো আড্ডা।
ঝলসানো খাবার পরিবেশন করা হলো। সেই সঙ্গে ওয়াইনের গেলাস হাতে নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়লো সবাই। পান খাওয়া আড্ডা চললো অনেকক্ষণ। নানা গল্প, নানা স্মৃতি, নানা কথা একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করা চললো প্রায় রাত সাড়ে দশটা অবধি।
সন্ধ্যের অধিবেশন শেষ করে আবার সকলে শানের গোল টেবিলে গিয়ে বসলাম। হালকা করে খেতে হবে, হবেই। অনুরোধ এলো মালিকের পক্ষ থেকে।
কাঁসার থালায় পরিবেশিত হলো গোবিন্দভোগ চালের নরম ভাত, ঘী, কাঁচা লংকা, আলু সিদ্ধ মাখা, মটর ডাল সিদ্ধ, ডিম সিদ্ধ আর কুড়মুড়ে মাছ ভাজা। কেউ খুব একটা না করলো না। আসলে নিষ্কলুষ পরিবেশ আর সাস্থকর পানীয় জলের জন্যে খিদেও পাচ্ছিলো আর খাবার তাড়াতাড়ি হজমও হয়ে যাচ্ছিলো।
পরের দিন ফিরে যেতে হবে। সকলে উঠে যে যার মালপত্র গুছিয়ে নিলাম। তাড়াতাড়ি লাঞ্চ খেয়ে বেরোতে হবে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ধরতে, তাই জলখাবারের পরিপাটি ব্যবস্থা করতে মানা করেছিলাম। মেয়েরা খেলো পিৎজা, আমরা চা বিস্কুট।
এগারটা নাগাদ খেতে বসলাম। আগেই দেখেছি নিজেদের পোলট্রি থেকে তিনটে মুর্গি এনে পালক ছাড়িয়ে খড়ের আগুনে হালকা ঝলসে পরিষ্কার করে নিচ্ছিলো মদন বাবু। সেই দেশী মুর্গির ঝোল এলো ভাতের সঙ্গে। আর একটা সারপ্রাইজ ছিলো পরিবেশনে। কাচকি মাছের বড়া। সে এক দারুণ সুস্বাদু মুচমুচে ভাজা। আর ছিলো মুসুরির ডাল আর পেঁয়াজ কাঁচা লংকা। তরিবৎ করে খেলাম কবজি ডুবিয়ে। একটু তাড়াতাড়ি করে খেতে হলো, কারণ ফেরার ট্রেন ধরতে যেতে হবে বোলপুর স্টেশানে।
খাওয়ার শেষে সবাই যে যার ঘর থেকে মালপত্র নিয়ে জড়ো হলাম মেন গেটের সামনে। আগে থেকেই বলে রেখেছিলাম গাওয়া ঘী কিনে নিয়ে যাবো। সেইমতো একটা কাপড়ের মানুষের ঘরবাড়ী ছাপানো ব্যাগে করে তৈরী ছিল আমার ঘীয়ের বয়াম।
পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দিয়ে রামকৃষ্ণের গাড়ীতে চড়ে বেড়িয়ে পড়লাম। মনে মনে বললাম যে এইখানে, এই শান্তির পরিবেশে আবারও আসতে হবে। এক অসামান্য থাকা খাওয়া আড্ডার অভিজ্ঞতা নিয়ে মানুষের ঘরবাড়ীকে এই যাত্রায় টাটা বাইবাই করে দিলাম।
সকলেরই একটু মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু ফিরতে তো হবেই নিজেদের ডেরায়।
Debashis Bhattacharya