মানুষের ঘর বাড়ী
চারপাশে যত দূর চোখ যায় নিরালায় সবুজ ধান ক্ষেতে পরিবেষ্টিত আনুমানিক ১৮/ ২০ বিঘা জমির ওপর 'মানুষের ঘর বাড়ি'। এটি হোটেল বা রিসোর্ট নয়, নিখাদ ' হোম স্টে '।
যাঁরা অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাস সিরিজের দ্বিতীয় খণ্ডটি পড়েছেন, সহজেই অনুভব করতে পারবেন এই হোম স্টে'র নামের যথার্থতা। এক টুকরো ধানি জমি অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে এক বিশাল দিঘি আর শ্যামলিমায় আচ্ছাদিত অতি সাধের, পরম স্নেহমাখা 'মানুষের ঘরবাড়ি' ।
শহরের শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে, কটা দিন প্রাণ মন জুড়িয়ে, সতেজ হয়ে আসার জন্য সহজেই চলে যাওয়ার সুন্দর গন্তব্য স্থল । বোলপুর বা প্রান্তিক স্টেশন থেকে গাড়িতে ৩৫/ ৪০ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যায় লাভপুর এর কাছে চাতরা গ্রামের মানুষের ঘর বাড়িতে।
আমাদের দুরাত্রির অবস্থানে আমি আমার সব ইন্দ্রিয় দিয়ে শুষে নিচ্ছিলাম প্রকৃতির গন্ধ, স্পর্শ, শোভা। পূর্ণিমার পরের রাতের চন্দ্রোদয় যেমন নয়নলোভা লেগেছে , আমি নিশ্চিত অমাবস্যার ঘন কালো আকাশে তারা দেখাও ততটাই আকর্ষণীয় হবে। সাথে উপরি পাওনা ঝোপঝাড় এ জোনাকির ঝিকিমিকি আলো! প্রসংশনীয় বিষয় অত্যধিক নজরকাড়া রঙের ইট কাঠের জঙ্গল না বানিয়ে এখানে বাস্তুতন্ত্র কে যতটা সম্ভব বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই শেয়াল, বেজী, নানান ধরণের পাখী, পোকা মাকড় এর সাথে এখানের বসবাসকারী মানুষদের স্বচ্ছন্দ সহবস্থান চোখে পড়েছে। অতিথিদের আনন্দ উপভোগের জন্য নানান ব্যবস্থা রয়েছে যেমন, গাছের ডালে বাঁধা হ্যামোক, বন্দুক শুটিং এর জন্য চাঁদমারি, দিঘিতে বোটিং, ছিপে মাছ ধরার ব্যবস্থা ইত্যাদি। অগুনিত গাছ, আর বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতের মাঝ দিয়ে ভোরের আলো গায়ে মেখে পাখিদের কলতান শুনতে শুনতে হেঁটে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা অনন্য।
খাওয়া দাওয়ার সিংহভাগ অর্গানিক, হোম স্টের নিজস্ব ক্ষেতের। দিঘিতে মাছ চাষ আর গরু, মুরগী, হাঁস, খরগোশ পালনও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শুনেছি শীতকালে পরিযায়ী হাঁসেরা দল বেঁধে আসে ওখানে দিঘির জলে। সেও নিশ্চয় অতীব দর্শনীয় হবে।
কাছেই ৭ কিলোমিটার দুরে দেখে আসা যায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মভিটা লাভপুর আর ৫১ পীঠের এক পীঠ অট্টহাস ফুল্লোরা মন্দির। ইচ্ছে করলে টোটো নিয়ে বৈষ্ণব পদাবলীখ্যাত কবি চণ্ডীদাসের সাধনভূমি নানুর ঘুরে আসা যায়, সেখানে দর্শনীয় কয়েকটি টেরাকোটার মন্দির ও আছে।
যেহেতু হোম স্টে, বাড়ীতে যেমন অনুশাসন, নিয়মকানুন থাকে এখানেও আছে। প্রতি ঘরে ল্যামিনেট করা কাগজে নিয়মাবলী লেখা আছে, যার প্রতিটি আমার যথাযথই মনে হয়েছে।
মোট চারটি ঘর। ঘরগুলি সমমানের নয়। একটি মাটির দোতলা বাড়ি এথনিক, অত্যন্ত রুচিসম্মত সাজানো। নিচে একটি ঘর, ওপরে একটি ঘর, দুটিই নন এ সি। ওপরের ঘরটিতে ওঠার সিঁড়ির রঙ কালো, বয়স্ক মানুষ বা পায়ে অসুবিধে থাকলে ওইটি না নেওয়া ভালো । নিচের ঘরের সাথে চারপাশের বারান্দা অতি আকর্ষণীয়। সকালে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে চোখ মেলে দেওয়া যায় দুর দূরান্ত পর্যন্ত সবুজ গালিচার মত ধান ক্ষেতে।
একটি ঘর ' পাকা বাড়ী ' গ্রীল ঘেরা বারান্দা সহ একটি এ সি ঘর। এই ঘর থেকে বাইরের দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না। তবে এমন জায়গায় এসে ঘরে কে আবদ্ধ থাকবে! আমরা তো কেবল রাতে ঘুমাতে যেতাম। অন্য ঘরটি ডিলাক্স এ সি , উন্নত মানের সুযোগ সুবিধাসহ। সব ঘরেই এটাচড বাথরুম।
বন্ধু বান্ধব বা সহকর্মীরা একসাথে গেলে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব থাকলে রুম ভাগে অসুবিধা হতে পারে। তবে এটুকু বলতে পারি ওখানে প্রকৃতির প্রাচুর্য, আকাশের বিশালতা, প্রতিটি খাবারের স্বাদ ও পরিবেশনা, উপস্থিত মানুষ জনের আন্তরিকতা, আতিথেয়তা, ফেরার সময় অতি আপনজনের মত উপহারের থলি হাতে ধরিয়ে দেওয়া সব ছাপিয়ে শুধু ভালোলাগা টুকুই থেকে যাবে।
আমি আবারও ' মানুষের ঘর বাড়ী ' তে যাবার সুপ্ত বাসনা জমিয়ে রাখলাম। ।
ভালো থেকো ' মানুষের ঘর বাড়ি' র মানুষ ও 'না মানুষ' সকল সদস্য।
Sharmistha Bhattacharya